‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন : কিছু কথা
- মো: বেলাল হোসেন
- ১৫ জানুয়ারি ২০১৯, ১৩:১৫
আমাদের জাতীয় জীবনে বহু কাঙ্ক্ষিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছে। অন্য দিকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর বলা হলেও সারা দেশে জনতার চোখে দেখা ভোটের বাস্তব চিত্র এবং গণমাধ্যমে উঠে আসা খবর ও তথ্যে এ নির্বাচন ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ হওয়ার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান রয়েছে বলে ইতোমধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সেসব কারণ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
০১. তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের আগের রাত পর্যন্ত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ২৭ প্রার্থীসহ তাদের বিপুল নেতাকর্মী ও এজেন্টকে গায়েবি মামলায় গ্রেফতার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে হানা দেয়। এ ছাড়া মামলা-হামলা, গুম-খুনের ভয় দেখিয়ে ভীতি সঞ্চার করে ভোটের মাঠ থেকে তাদের বিতাড়ন করেন।
০২. ভোটের বিশাল ব্যবধানই প্রমাণ করে, ভোটে ব্যাপকভাবে কারচুরি হয়েছে।
০৩. ব্যালট ও ইভিএমে ভোট গ্রহণের হারে বিশাল ব্যবধান হওয়া।
০৪. কোনো কোনো কেন্দ্রে সকাল ১০ থেকে ১২টায় ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেয়ার পর বন্ধ কক্ষে সিল মারার ব্যবস্থা করা হয়। ওই সব কেন্দ্রে বৈধ ভোটাররা ভোট দিতে এলেও তাদের বলা হয়; ব্যালট শেষ হয়ে গেছে; আপনারা চলে যান।
০৫. কোনো কোনো কেন্দ্রে সরকারদলীয় লোকজন ব্যালটে নৌকা মার্কায় জোর করে সিল মারতে বাধ্য করে ভোটারদের। যারা প্রকাশ্যে সিল মারতে চাননি, তাদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ।
০৬. যেসব জায়গায় বিরোধীদের এজেন্ট দেয়া ছিল, তাদের বেশির ভাগকে কেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়া এবং যারা ঢুকেছিলেন, তাদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ।
০৭. পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের কাছে সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন প্রমাণ করতে কেন্দ্রে কেন্দ্রে খুব ধীর গতিতে ভোট নিয়ে একদিকে দীর্ঘ লাইন দেখানো, অন্য দিকে কক্ষের ভেতরে সরকারদলীয় লোকজন ও ভোটগ্রহণে নিয়োজিত কিছু কর্মকর্তার সমন্বয়ে মহাজোটের মার্কা নৌকায় সিল মারা।
০৮. অনেক কেন্দ্রে সকাল ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে কোনো না কোনো অজুহাত দেখিয়ে অথবা গোলযোগ বাধিয়ে ভোটগ্রহণ বন্ধ করা, ভোটারদের কেন্দ্র থেকে চলে যেতে বাধ্য করা এবং ভেতরে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মহাজোটের প্রার্থীর মার্কায় ব্যালটে সিল মারা।
০৯. অনেক জায়গায় কোন পর্যবেক্ষক বা সাংবাদিক কোন কেন্দ্রে যাচ্ছেন কৌশলে তার খবর জেনে নিয়ে সে অনুযায়ী পর্যবেক্ষণের বা সংবাদ সংগ্রহের আগে-পরে মহাজোটের মার্কায় সিল মারার ব্যবস্থা করা।
১০. কোনো কোনো কেন্দ্রে সৃষ্ট গোলযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এলেও ভোটগ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করে বন্ধ কক্ষে মহাজোটের মার্কায় সিল মারা অব্যাহত রাখা।
১১. নির্বাচনের আগের রাতে ১৫০টি আসনের প্রায় সবক’টি কেন্দ্রে মহাজোটের প্রার্থীর মার্কায় ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ উঠেছে।
১২. ভোট জালিয়াতির অভিযোগে দুপুর ১২ থেকে ১টার দিকে প্রায় ১৫০ আসনে সরকারবিরোধী জোটের প্রার্থীরা ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকরা যা-ই বলুন না কেন, অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। ইতোমধ্যে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত চেয়েছে জাতিসঙ্ঘ ও ইইউ। ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন হওয়ায় দেশে বিরাজমান সঙ্কট সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং সঙ্কট আরো ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি প্রতীয়মান হচ্ছে, যা এ দেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পথে এক বড় হুমকি হতে পারে। কারণ ঐক্যফ্রন্টসহ দেশের বেশির ভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দল নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে পুনর্নির্বাচন দাবি জানিয়েছে।
কাজেই বিরাজমান সঙ্কট সমাধানে এক দিকে আমরা বিরোধী দলগুলোকে অনুরোধ করব, ফল মেনে নিয়ে নিজেদের ভুলত্রুটি সংশোধন করে দেশ ও জাতির কল্যাণে আগামীর জন্য তৈরি হোন। নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে সেখানে আইনি লড়াইয়ে এর মোকাবেলা করুন। তবে দেশ অস্থিতিশীল হয় এমন কোনো পন্থায় না যেতে বিরোধী রাজনীতিকদের প্রতি আমাদের অনুরোধ রইল। অন্য দিকে সরকার যদি দেশের স্বার্থে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে আগামীতে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করে, তবে এ সঙ্কট থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে বলে আমরা মনে করি।
লেখক : জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ইমাম, লালমনিরহাট